খাদি কাপড়

খাদির কদর বাড়ছে

চরকায় বোনা খাদি কাপড় আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ। হাজার বৈচিত্র্যের মধ্যেও খাদি পোশাকের গুরুত্ব কমেনি বরং বুননবৈচিত্র্যে যুগ যুগ পেরিয়ে মানুষের কাছে এর আকর্ষণ নতুন করে ফিরে এসেছে। এখন তো খাদি হয়ে উঠেছে রঙিন, ডিজাইনের ভিন্নতায় অনন্য। ফলে তরুণদের মনও জয় করে নিয়েছে খাদি। বিশেষ করে, বাংলাদেশে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর কদর বাড়তে থাকায় মানুষের মধ্যেও খাদি কাপড়ের কদর বাড়ছে। মানুষের চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো খাদি কাপড়ের পোশাক নির্মাণে বিশেষ নজর দিচ্ছে, আনছে নিত্যনতুন ডিজাইনের খাদি কাপড়ের পোশাক। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক বাঙালির কাছে খাদির কদর দিন দিন বাড়ছে।

তবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খাদি কাপড়ের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাঁতিরাও পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ১৯৬২ সালে কুমিল্লায় তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের একটি জরিপ হয়েছিল। সে জরিপে কুমিল্ল­া অঞ্চলে ২৫ হাজারের বেশি তাঁত এবং এ কাজে জড়িতদের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। বর্তমানে শিল্পকারখানার আধুনিকায়নের ফলে এ শিল্প মেশিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলেও সুদীর্ঘ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কারণে কুমিল্ল­ার তাঁতিরা এ শিল্পকে দেশ তথা বিশ্বের বুকে কুমিল্ল­ার খদ্দর হিসেবে টিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আজও ঐতিহ্য, সুনাম ও খ্যাতি অক্ষুণ্ন রাখার লড়াইয়ে রয়েছে কুমিল্লার খাদি। বাংলাদেশে খাদি বুননের চল আমাদের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল। তবে স্বদেশি আন্দোলনের কারণে কুমিল্লার অভয়াশ্রম, চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ ও নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমে খাদি বোনা হতো। খাদি বা খদ্দর নামকরণ প্রসঙ্গে নানা কথা রয়েছে কুমিল্লায়। খাদা বা গর্তে বসে তাঁতে কাপড় বোনা হয় বলেই খাদি নামকরণ হয়েছে—এমন একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, দেশি তুলা থেকে হাতে চরকায় সুতা কেটে হস্তচালিত তাঁতে যে কাপড় তৈরি করা হয় তাকেই খাদি বা খদ্দর কাপড় বলে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, খদ্দর নামকরণটি মহাত্মা গান্ধীর দেওয়া। কারণ খদ্দর শব্দটি গুজরাটি শব্দ। মহাত্মা গান্ধীর বাড়ি ভারতের গুজরাটে।

ইতিহাসের পাতায় কুমিল্লার খাদি

কুমিল্লায় খদ্দরের ব্যাপকতার কারণ সম্পর্কেও নানা কথা রয়েছে। তবে এটির জনপ্রিয়তার পেছনে মহাত্মা গান্ধীর একটি ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তত্কালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশি আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিদেশি কাপড় বর্জন করে দেশীয় তুলায় চরকায় কাটা সুতা দিয়ে তাঁতে তৈরি কাপড় ব্যবহারের আহ্বান জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২১ সালে নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতির একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্ল­া শহরের অভয়াশ্রমে। সে সময়ে খদ্দর কাপড়ের ব্যবহার বেড়ে গেলে মুসলমানরাও তাঁতশিল্পে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করে। এর আগে এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন হিন্দু নাথ ও যোগী সম্প্রদায়ের লোকেরা। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতি অভয়াশ্রমের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নেয়। সে সময়ে কুমিল্লার খাদিশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। এর পরও হাল ছাড়েননি এতদঞ্চলের তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। সে সময়ে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এর হাল ধরেন কুমিল্ল­া পদ্ধতির জনক এবং বাংলাদেশ পল্ল­ী উন্নয়ন একাডেমি—বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান। তারই উদ্যোগে এবং তত্কালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় ১৯৫৬ সালে অভয়াশ্রমকেন্দ্রিক ‘দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ধুতি, লুঙ্গি, শীতের চাদর, রুমাল ও গামছাজাতীয় কাপড়ের জন্য তাঁত ছাড়া বিকল্প ছিল না।

সেই সময় কুমিল্লার গ্রামগুলোতে হাতে সুতাকাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। বিশেষ করে চান্দিনা উপজেলার আওরাল, বাড়েরা, মাধাইয়া, কুটুম্বপুর, বেলাশ্বর, হারং, রাড়িরচর, কলাগাঁও, গণিপুর, দেবীদ্বারের বরকামতা, সাইতলা, ফুলতলী, দোবারিয়া, বাখরাবাদ, ভানী, গুঞ্জর, দাউদকান্দির গৌরীপুর, মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, জাফরাবাদসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হস্তচালিত তাঁতশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষ হাতে সুতা কাটার পেশায় জড়িয়ে পড়ে।

কুমিল্লার খাদির কথা উঠলে গুহ পরিবারের নাম আসবেই। চান্দিনাতে ড. আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেডের হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন গুহ। শৈলেন্দ্রনাথ গুহ চান্দিনার খাদি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ খাদিশিল্পের সুনাম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনবরত কাজ করে গেছেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে অরুণ গুহ হাল ধরেছেন বাবার চালু করা গ্রামীণ খাদি প্রতিষ্ঠানটির। পরবর্তীকালে ঢাকার ফ্যাশন হাউজগুলো এই অরুণ গুহের কল্যাণেই আদি খাদি কাপড়ের সন্ধান পায়।

দামে কম, গরমে আরাম

কুমিল্লার বেশ কয়েকটি উপজেলা এলাকার সহস্রাধিক তাঁতি পরিবার এ শিল্পের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। সুতা ও রংয়ের উচ্চ মূল্যসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বর্তমানে অল্প কিছু তাঁতি কোনো রকমে তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছেন। চান্দিনার আওরাল গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ, হরিচরণ দেবনাথসহ বেশ কয়েক জন জানান, প্রতি কেজি সুতা বিক্রি করা হয় ৩৪০ থেকে ৩৬০ টাকায়। খাদিশিল্পীরা তাদের নিকট থেকে সুতা কিনে খাদি তৈরি করে। তবে বর্তমানে শুধু তুলার সুতা দিয়ে খাদি উত্পাদিত হয় না। খাদি সুতার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে সেই সুতার মিশ্রণে কারিগররা খাদি তৈরি করছে। ফলে খাদির আদি রূপ বদলে গেছে এবং খাদি কাপড় পড়ে এখন আর আগের মতো আরাম পাওয়া যায় না।

বর্তমানে কুমিল্লা মহানগরীর প্রায় অর্ধশত অভিজাত খাদি দোকানে খাদির বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। ঈদ, নববর্ষ ও পূজা উপলক্ষ্যে খাদির পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার বেশ চাহিদাও রয়েছে। সাড়ে ৩০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় খাদির পাঞ্জাবি পাওয়া যায়। ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকায় থ্রি-পিস, ৭০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় শাড়ি, ৮০ থেকে ২০০ টাকায় প্রতি গজ থান কাপড়, ৬০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকায় বেড শিট, কাপড় ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায়, শার্ট ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়, লুঙ্গি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় পাওয়া যায়।

কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর এলাকার খাদি কাপড়ের ব্যবসায়ী প্রদীপ কুমার রাহা জানান, সুতার মূল্যবৃদ্ধির কারণে বর্তমানে খাদি কাপড়ের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে ক্রেতাদের সুবিধার্থে এখনো খাদিসামগ্রী কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন দোকান থেকে যে মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে, তা দেশের অন্য যে কোনো স্থানে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, দামে ও গুণমানে কুমিল্লার খাদির চেয়ে এত কম মূল্যে কোন ব্র্যান্ডের কাপড় পাওয়া যায় না। অথচ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খাদিশিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না।

খাদির নামে বাজে কাপড়ে বাজার সয়লাব

বিশুদ্ধ খাদি এখন বাজারে নেই বললেই চলে। শুধু চান্দিনা ও দেবীদ্বারের কিছু এলাকায় খাদিশিল্প এখনো টিকে থাকলেও অধিকাংশ তাঁতি পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন। চান্দিনার কিছু তাঁতি ও কাটুনী বিভিন্ন বস্ত্র মিল থেকে ব্যবহারের অযোগ্য সুতা সংগ্রহ করে সেগুলো থেকে বেছে বেছে চরকায় সুতা কাটছেন। এই সুতা ও মিলের সুতার মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে বর্তমান খাদিবস্ত্র। ফলে এখন আর চাইলেই আসল খাদি কাপড় পাওয়া যায় না। কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার দক্ষ পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক। বন্ধ হয়ে গেছে গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে বাড়তি আয়ের সুযোগ।

প্রতিদিন গড়ে একটি তাঁত থেকে তৈরি হয় সর্বোচ্চ ১২ গজ কাপড়। তাঁতিরা জানান, তারা বিভিন্ন মহাজনের কাছ থেকে ওজন ধরে সুতা আনেন এবং যত কেজি সুতা আনেন সে পরিমাণ ওজনের তৈরি কাপড় তাদের সরবরাহ করতে হয়। এজন্য মহাজন তাদের ১২ গজে মাত্র ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দেন। তা থেকে শ্রমিককেও দিতে হয় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ফলে তাদের লাভের খাতা থাকে শূন্য। এ অবস্থায় পৃষ্ঠপোষকতাহীন খদ্দরশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। সুলভ মূল্যে সুতা ও রংয়ের অভাবে প্রকৃত তাঁতিরা সে সময় তাদের মূল পেশা বদল করতে বাধ্য হয় বলে জানান চান্দিনার বৃদ্ধ তাঁতি দেবেন্দ্র দেবনাথ।

রানীর বাজার রোড, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা – ৩৫০০

author-avatar

About Cumilla Khadi

***Cumilla Khadi - কুমিল্লা খাদি {www.cumillakhadi.com}*** Tradition and modernity - ঐতিহ্য এবং আধুনিকতায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *